সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

গোলাপ, বকুল, মোমবাতি আর জোনাকি

আজ আমার বিয়ে।
অভি বলেছে প্রথম রাতে আমরা কিছুতেই ঘুমাব না। প্রথম রাতটা নিয়ে আমাদের অনেক প্ল্যান। বিছানায় গোলাপের পাপড়ি থাকবে ঠিকই। কিন্তু মেঝেতে ছড়ানো থাকবে বকুল। বকুলের গন্ধটা দূর থেকে মিষ্টি। কিন্তু কাছে আনলে অসহ্য রকম তীব্র। তাই ওটাকে মেঝেতে রাখা। ঘর অন্ধকার করা যাবে না। মোমবাতি জ্বলবে সারা ঘরে।
প্রথমে বলেছিল জোনাকি পোকা জমিয়ে রাখবে। বিয়ের একমাস আগে ও জঙ্গল ভ্রমনে যাবে শুধুমাত্র জোনাকি পোকা সংগ্রহ করতে। বাক্স বাক্স জোনাকি পোকা ধরে আনবে। তারপর বন্ধ ঘরে অন্ধকারে খুলে দিবে সবগুলো বাক্স। আমি হেসে বললাম, জোনাকি পোকা কিন্তু মাছির মতো সাইজে। স্বভাবেও তার ব্যতিক্রম হবে বলে মনে হয় না। ধরো আমরা বসে আছি খাটের ওপর। সারা ঘরের সব জোনাকি আমাদের হাতে-পায়ে-গায়ে বসছে; নাকের ভিতর কানের ভিতর ঢুকে যাচ্ছে- তখন কী হবে?
- তাই তো! মশারি খাটিয়ে দিলে হবে না?
- বাসর ঘরে পোকার ভয়ে মশারির ভিতর ঢুকে থাকব। মানে হয় কোন?
- তাহলে জোনাকি বাদ। মোমবাতিই জ্বলুক সারা ঘরে।
- সেটা মন্দ নয়। কিন্তু হঠাৎ যদি মোমবাতি পড়ে গিয়ে জানালার পর্দা কিংবা বিছানার চাদরে আগুন ধরে যায়! তখন কী হবে?
-ধুর ছাই! আগুন ধরবে কেন! আমরা কী মরে থাকব না কি ওখানে! সারা রাতই তো জেগে থাকব।
- জেগে থাকব ঠিক আছে। কিন্তু তখন হুশ তো থাকবে না।
- হুশ থাকবে না মানে! অবশ্যই থাকবে। তোমার না থাকলেও আমার থাকবে।
- তোমার! তুমি তো এখনি বেহুশ! হা হা হা!
অভি আসলেই বেহুশ। ও যখন আমার সাথে কথা বলে তখন পৃথিবীর সবকিছু ভুলে যায়। একদিন ফোনে কথা বলতে বলতে তো ড্রেনেই পড়ে গিয়েছিল। ছয় ফিট লম্বা, ব্লু জিন্স হোয়াইট টি-শার্ট পরা অতি সুদর্শন যুবক বাইক সহ ড্রেনে! এবং এই কাদা পানি মাখা অবস্থায় আমার সামনে এসে বলল, Will u accept me even when I smell like shit?
আমাদের সম্পর্ক বন্ধু-বান্ধব এমনকি দুই পরিবারের সবারই জানা ছিল। দুই পরিবারের সম্মতিতেই আমাদের বিয়ের দিন তারিখ ঠিক হয়। শুধু প্রথম রাত নয়, আমরা আমাদের সারা জীবনের সবকিছুই প্ল্যান করে রেখেছি। এর মধ্যে বাচ্চাদের নামের সাথে নাতি-নাতনীর নামও ঠিক।
তবে প্রথম রাতের প্ল্যান নিয়ে একটু বেশিই মাতামাতি ওর। ও বাজি ধরেছে প্রথম রাত ও জেগেই থাকবে শুধু। কিন্তু কিছুতেই দু আঙ্গুলেও আমায় ছোঁবে না। শুধু দেখবে।
ও কিছু করবে বললে সেটা করে ছাড়ে। কিন্তু এই বিষয়ে কতটা প্ল্যান মাফিক থাকতে পারবে সেটা নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। ওকে নিয়ে সন্দেহ থাকলেও নিজেকে নিয়ে নেই। যদি দেখি সত্যিই ও হাবলা দাশের মতো তাকিয়ে থেকেই বসে আছে। তো ও থাকবে। আমি থাকতে পারব না। ওর গলায় শাড়ির আঁচল বেঁধে বলব, Get urself out if u can.
ঘরের মেঝেতে পা রেখেই বুঝলাম নিচে বকুল ফুল। অবশ্য সেটা বোঝার জন্য পা রাখার প্রয়োজন ছিল না। বকুলের গন্ধই নিজের অস্তিত্বের জানান দিতে যথেষ্ট। আমার সাদা গোলাপ পছন্দ, অভির লাল। বিছানায় লাল-সাদা দুই রঙের গোলাপের পাপড়িই আছে। কিন্তু কোন মোমবাতি নেই। ঝলমলে বৈদ্যুতিক আলোর নিচেই বসে আছি। দরজায় পায়ের শব্দ শুনেই বুঝলাম ও এসেছে। আমি ফিরে তাকানোর প্রয়োজন বোধ করিনি। ও দরজাটা বন্ধ করেই লাইট বন্ধ করে দিল। আর সঙ্গে সঙ্গেই দেখতে পেলাম মোমবাতির আলো।
ও ধীরপায়ে কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো, ১৪৩ টা মোমবাতি আছে। আমি একাই সব জ্বালাব না তুমিও আসবে?
আমি এই প্রথম বারের মতো ওর মুখের দিকে তাকালাম। অভির মুখের সাথে ওর কোন মিল নেই, মিল নেই কণ্ঠ স্বরেরও। মিল শুধু একটা জায়গায় যে ও আমাকে প্রচণ্ড রকম ভালোবাসে, অভিও বাসতো। অভির বেস্ট ফ্রেন্ড হবার সুবাদে আমাদের সবকিছুই ওর জানা ছিল। এমনকি অভির ব্যক্তিগত ডাইরিও ও পড়ত। আমি জানতাম সেটা। আমাদের ব্যাপারে ও সবকিছু জানলেও আমরা শুধু ওর ব্যাপারে এটুকুই জানতাম যে ও একটা মেয়েকে ভালোবাসে। সেই মেয়েটা যে আমিই সেটা অভির মৃত্যুর আগ পর্যন্ত জানতে পারিনি।
আজ থেকে ছয় বছর আগে ঠিক আজকের এই তারিখেই অভির সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়। বিয়ের হাতে গোনা ১১ দিন আগে আমার সাথে ফোনে কথা বলা অবস্থাতেই ও বাইক সহ রেলক্রসিংয়ের সময় ট্রেনে কাটা পড়ে। ওরা অভির কিছুই পায়নি। কাটাছেড়া কিছু মাংসের দলা এনে বলেছিল এটা আমার অভি। ওর বাইকটা ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিল। তবুও আমি চিনতে পেরেছিলাম ওটা অভির বাইক। কিন্তু অভিকে আমি চিনতে পারিনি। ওই রক্তাক্ত মাংসের দলায় কোথাও আমার অভি ছিল কি না আমি জানি না। ওরা বলেছিল মাংসপিণ্ডগুলোই অভি।
আমার পুরোপুরি জ্ঞান ফেরে প্রায় দুই মাস পর। এর মাঝে যতবারি আমি চোখ মেলে তাকিয়েছি শূন্য দৃষ্টিতে শুধু চেয়ে থেকেছি কিছুক্ষণের জন্য। চারপাশে শুধু রক্ত আর মাংস দেখেছি। আর দূর থেকে যেন ভেসে আসতে শুনেছি অভির সেই শেষ চিৎকার- নি...শা...ত...!
এরপর আমাকে মানসিক হাসপাতালে থাকতে হয়েছে টানা চার বছর। হাসপাতালের বারান্দায়, রাস্তার ধারে, এখানে-সেখানে সবখানে রোজ আমি অভিকে অন্তত একবার হলেও দেখতাম। কী কাতর চোখে যে ও চেয়ে থাকতো আমার দিকে!
মাঝেমাঝে ও আমার বিছানার পাশে এসে বসতো। আমার খুব ইচ্ছে করতো ওর কোলে একটু মাথা রাখতে, ওর হাতটা একটু ছুঁয়ে দেখতে, ওর বুকে আলতো করে মাথা রেখে হৃৎপিণ্ডের ধুকধুক শব্দ শুনতে। ইচ্ছে করতো ওর গলায় শাড়ির আঁচল বেঁধে বলতে- Get urself out if u can!
কিন্তু ও কিছুতেই যেন আমার নাগালের ভিতরে আসতো না। যেন ও সেই প্রথম রাত নয়, সারা জীবন আমাকে ছোঁবে না বলে বাজি ধরেছে। দূর থেকেই শুধু কাতর নয়নে চেয়ে থাকতো আমার দিকে। কাছে এলে সেটাও না। মাথা নিচু করে বসে থাকতো শুধু।
একদিন দূর থেকে তাকিয়ে থাকতে দেখে আমি ওকে ইশারায় কাছে ডাকি। ও মাথা নিচু করে আমার খাটের পাশে এসে বসে। আমি হাত বাড়িয়ে ওকে ছোঁয়ার চেষ্টা করতেই ও আমার হাত ধরে মেঝেতে বসে পড়ে। ওর দুচোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিল। ও আমার হাতটা বুকে জড়িয়ে বলল, ঘরে চলো, নিশাত। আমি এখানে এ অবস্থায় তোমাকে আর দেখতে পারছি না। প্লিজ, নিশাত! সুস্থ্য হও।
সেদিনই আমি অবাক হয়ে খেয়াল করলাম এই ছেলেটা আমার অভি নয়। ও অভির বেস্ট ফ্রেন্ড রাকিব।
ডাক্তার বলেছে এখন আমি পুরোপুরি সুস্থ্য। হাসপাতাল থেকে আসার পরও প্রথম এক বছর প্রতি তিন মাস পরপর আমাকে চেকআপের জন্য হাসপাতালে যেতে হয়েছে। রাকিব ছিল পাশে। অভির মৃত্যুর পর এই ছয় বছরে রাকিব একবারও আমাকে ভালোবাসি বলেছে বলে আমার মনে পড়ে না। কিন্তু ওর সেদিনের কান্না আমি ভুলিনি। হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরার পর যতবার ও আমাকে দেখতে এসেছে, যতবার আমাকে নিয়ে বাইরে বেরিয়েছে প্রতিবারই হঠাৎ ওর দিকে চোখ পড়তেই দেখতাম ও কেমন করে যেন আমার দিকে তাকিয়ে আছে! ঠিক যেমন করে পূজারি প্রতিমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
এই ছয় বছরে রাকিব আমার জন্য কী কী করেছে সেটা রাকিব এবং আমার পরিবারের সবারই জানা ছিল। বাবা যখন সঙ্কিত কণ্ঠে রাকিবের ব্যাপারে আমার সাথে আলাপ করতে আসে তখন আমি একটা কথাই শুধু বলেছিলাম- বিয়ের তারিখটা সেদিনই হোক যেদিন অভির সাথে আমার বিয়ে হবার কথা ছিল।
হলোও তাই। রাকিব মোমবাতি হাতে আমার সামনে দাঁড়িয়ে। আমার কাছ থেকে সাড়া না পেয়ে ও নিজেই বাকি মোমবাতি গুলো জ্বালানোর উদ্দেশে পা বাড়াতেই আমি ওর হাত চেপে ধরলাম। মোমবাতির আলোতে ওর চোখের জল চিকচিক করে উঠলো আরেকবার। অথচ আমার চোখে কোন জল ছিল না কখনো। আমি কাঁদতে পর্যন্ত পারিনি বহুকাল ধরে। রাকিব কী আজ আবার কাঁদবে! তাহলে আমিও একটু কাঁদি! ওকে জড়িয়ে ধরে কাঁদি।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

Baahubali: The Beginning - Plot Summary

Baahubali: The Beginning Plot Summary When Sanga and her husband, part of a tribe living around the province of Mahismathi, save a drowning infant, little do they know the background of the infant or what the future holds for him. The kid grows up to as Shivudu, a free-spirit wanting to explore the mountains and in the process learns of his roots and then realizes the whole purpose of his life and ends up confronting the mighty Bhallala Deva! It's a tale of two cousins in the Kingdom of Mahispati, India. Balla fights his way with ccousin Bahuballi for the throne. Young Sivudu grows in the tribes and travels to the distant lands above the waterfalls to fall in love with the beautiful Tamana, the tribal warrior and helps in her quest to rescue Devasena a prisoner from the claws of King Balla.In this quest he finds out that the legendary King Bahuballi is his father and Devasena the prisoner is his mother from the slave commander in chief katappa of King Balla. Ka...

আমার বউ

***বেশ কয়েকদিন আগে পোষ্টটা ফেবু সুডুতে দিয়েছিলাম। অনেক কমেন্টে ভেসে গিয়েছিলাম। সেই কথাগুলো হটাত মনে পড়লো। তাই শেয়ার করা। রুবেল ভাই এর কাছে আনুরোধ থাকবে সুডু গ্রুপ থেকে আমার পোষ্টটা খুজে লিকঙ্কটা আমাকে দিবেন পিলিজ লাগে। আমি সেই জুলাই মাসের পোস্টটা পাচ্ছিনা। গ্রুপে টাইম লাইন না থাকায় অনেক কষ্ট সেটা বুঝলাম। হাহাহা।*** কিছু পারসোনাল কথা শেয়ার করিঃ আমার বউ আমাকে যেদিন জিগায় আমার পূর্বের প্রেমের কথা আমি তাকে নিরাশ করি নাই-সব কই দিছি। এরকম সৎ সাহস কয় জনের আছে? -আমাগো যেদিন আংটি বদল হয় সেদিন আমার বউ আমাকে বলে তোমার প্রাক্তন প্রেমিকাকে জানাও নাই তোমার যে আজ আংটি বদল হচ্ছে? -আমি বলি না -ও বলে কি বলে কি বলে ফোন দাও? আমার কাছে নাম্বার ছিল না সেই কবে ডিলিট করে দিছি। মনেই করতে পারতেছিলাম না বউ যে আমার লগে প্রথম রাইতেই মজা লইতেছে বুঝতেছিলাম, যাই হোক পিড়াপিড়িতে ফোন নাম্বার জোগার করা হইলো। আমি তো ফোনই দি না জোর করে ও নিজেই ডায়াল করে বসে। ফোনটা ধরে প্রাক্তন প্রেমিকার মা। আহা-আমি আমার বউকে ফোনটা দিয়া বলি কথা কউ ওর মা ধরসে। ও নিজে হাসতে হাসতে শেষ। যাই হোক প্রাক্তন...

প্রেম VS ভালোবাসা

একটা মেয়ের শরীরের গন্ধ তোমার ভালো লাগে। এইটা হচ্ছে প্রেম। আরেকটা মেয়ে আছে , যাকে তুমি অনুভব করো। তাকে ভালো লাগার জন্য তার উপস্থিতি কিংবা শরীরের গন্ধ লাগে না। এটা হচ্ছে ভালোবাসা। কোন একটা মেয়ের সাথে রুমডেট করলে তুমি আনন্দ পাও। আরেকটা মেয়ে আছে যার কথা ভাবলেই তুমি আনন্দ পাও। প্রথমজন হচ্ছে তোমার প্রেমিকা। দ্বিতীয়জন হচ্ছে তোমার ভালোবাসার মানুষ। তোমার বন্ধু মহলে কোন একটা মেয়ে আছে যার সাথে তুমি গা ঘেঁষে বসার জন্য অস্থির থাকো। এই মেয়েটি হচ্ছে তোমার কামনার বস্তু। একই ভাবে তোমার মস্তিস্কের অন্দরমহলে একটা মেয়ে আছে যার সাথে তুমি গা ঘেঁষে বসার জন্য অস্থির না। কিন্তু তার অনুপুস্থিতির জন্য তুমি অস্থির। তার সাথে কথা বলার জন্য তুমি অস্থির। এই মেয়েটা হচ্ছে তোমার ভালোবাসার মানুষ। একটা মেয়ের নুড পিক দেখার জন্য সব সময় তুমি অপেক্ষা করো। আরেকটা মেয়ে আছে যার নুড পিক তোমার মাথাতেও আসে না । চাইলেও তুমি আনতে পারো না। প্রথমজন হচ্ছে তোমার প্রেমিকা। পরের জন হচ্ছে তোমার ভালোবাসা। একটা মেয়ের সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা ফোনে মজা নেয়ার পরেও তুমি মেয়েটার কথা ওইভাবে চিন্তা করো না। সব কিছু ফোনের ওই মজা পর্যন্তই। কিন্তু ...